কল্লোল আহমেদ
নির্বাহী সম্পাদক দৈনিক লালমনির আলো
বাংলাদেশ-এর নাম উচ্চারণের সাথে সাথে আমাদের মনে ভেসে ওঠে এক গৌরবময় ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধের আত্মত্যাগ, ভাষা শহিদদের রক্ত, নদীমাতৃক প্রকৃতি ও অপার সম্ভাবনার গল্প। তবুও এই দেশকে নিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলা হয়।
'এই হতভাগা অভাগা দেশের অবস্থা কোনদিনই পরিবর্তন হয়নি অসচেতন বাঙালি মানুষগুলোর জন্য।
কেন এই বেদনাবোধ? কেন আমরা ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটিয়েই চলেছি?
অতীতের আলেখ্য : গৌরব আর বেদনামিশ্রিত ইতিহাস
বাংলার মাটিকে একসময় বলা হতো সুবর্ণভূমি। ধান, পাট, মাছ, নদী, শিল্পকলা সবই ছিল অঢেল। কিন্তু শাসকশ্রেণি বদলেছে, বিদেশি বণিক এসেছে, আর সাধারণ মানুষ থেকেছে অবহেলিত।
ঔপনিবেশিক শাসনকালে ব্রিটিশরা বাংলার সম্পদ লুটে নিয়ে গেছে, মসলিন শিল্প ধ্বংস করেছে। দুর্ভিক্ষে লক্ষ মানুষ মারা গেছে। অথচ বাঙালি সমাজ তখনও বিভক্ত কেউ জমিদার, কেউ কৃষক, কেউ ইংরেজের অনুগত। ঐক্য ও সচেতনতার অভাব আমাদের শোষণকে দীর্ঘায়িত করেছে।
পাকিস্তান আমলে আমরা রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক বঞ্চনার শিকার হয়েছি। তখনও অনেকেই নিজেদের ক্ষুদ্র স্বার্থে বিভক্ত ছিল। তবে ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ ও ২৪ এর গণঅভ্যুত্থান প্রমাণ করেছে যখন বাঙালি ঐক্যবদ্ধ হয়, তখনই তারা নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তন করতে পারে।
স্বাধীনতার পর : আশার পর্দা ছিঁড়ে হতাশার আঘাত ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। কোটি মানুষের রক্তে রঞ্জিত এই স্বাধীনতা ছিল নতুন সূর্যোদয়ের বার্তা। মানুষ ভেবেছিল, আর দুর্নীতি-শোষণ থাকবে না; সবার জন্য সমতা ও ন্যায় প্রতিষ্ঠিত হবে।
কিন্তু ইতিহাসের নির্মম সত্য হলো—স্বাধীনতার পরপরই রাজনৈতিক অস্থিরতা, অভ্যুত্থান, দুর্নীতি ও দলীয় হানাহানি দেশকে ক্ষতবিক্ষত করেছে।
জনগণ ভোট দিয়েছে, কিন্তু সচেতন সিদ্ধান্তে নয়; দলীয় আনুগত্য, ব্যক্তিগত স্বার্থ আর আবেগপ্রবণতা মুখ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলস্বরূপ প্রকৃত গণতন্ত্র, জবাবদিহিতা ও দীর্ঘমেয়াদী উন্নয়ন বারবার বাধাগ্রস্ত হয়েছে।
আজকের বাংলাদেশ : অগ্রগতি ও বৈপরীত্য
বর্তমান বাংলাদেশ অনেকদূর এগিয়েছে
অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে,প্রযুক্তিতে উন্নয়ন হয়েছে, অবকাঠামো, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে। কিন্তু এর পাশাপাশি রয়েছে
দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, অসচেতন ভোটার, দলীয় বিভক্তি, সামাজিক অবক্ষয়।
ফলস্বরূপ দেশ যতই এগোক, ভেতরে ভেতরে অসচেতনতা আমাদের দুর্বল করে রাখছে।
প্রশ্ন : আমরা মানুষ কবে হবো?
মানুষ শুধু শরীরের অস্তিত্ব নয়—মানুষ মানে বিবেকবান, দায়িত্বশীল, সুশিক্ষিত ও সচেতন প্রাণী।
কিন্তু আমরা কি সত্যিই মানুষ হতে পেরেছি?
আমরা শিক্ষাকে শুধু চাকরির সোপান ভেবেছি, মানবিক মূল্যবোধ শেখাইনি।
আমরা ভোট দিই আবেগে, স্বার্থে কিন্তু দেশের ভবিষ্যৎ ভেবে নয়।
আমরা সন্তানদের জন্য সম্পদ জমাই, অথচ একটি সুন্দর সমাজ গড়তে পিছিয়ে যাই।
প্রশ্ন জাগে আমরা মানুষ হবো কবে? শুধু নামমাত্র মানুষ নয়, প্রকৃত সচেতন মানুষ?
আগামী প্রজন্মের জন্য আমাদের দায়
আমরা যদি অসচেতনই থাকি, তবে আগামী প্রজন্মকে আমরা কী দিয়ে যাবো?
ধ্বংসপ্রাপ্ত পরিবেশ? দুর্নীতিতে ভরা রাষ্ট্রব্যবস্থা?
নষ্ট রাজনীতি? না কি ভঙ্গুর মানবিকতা?
আমাদের উচিত—
সন্তানদের শুধু তথ্য নয়, মানবিক শিক্ষা দেওয়া,
ভোট ও রাজনীতিতে সচেতন সিদ্ধান্ত নেওয়া,
সমাজে ন্যায় ও সত্যের সংস্কৃতি গড়ে তোলা,
দেশকে শুধু নিজের জন্য নয়, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য রক্ষা করা।
বাংলার ইতিহাসে আমরা একই সঙ্গে বীরত্বপূর্ণ ও বেদনাদায়ক জাতি। যখন ঐক্যবদ্ধ হয়েছি, তখন জিতেছি; যখন বিভক্ত হয়েছি, তখন হেরেছি।
আজও সেই শিক্ষা আমাদের সামনে স্পষ্ট—
আমরা যদি সচেতন, সুশিক্ষিত ও দায়িত্ববান মানুষ না হই, তবে এই দেশকে “হতভাগা অভাগা” হিসেবেই দেখতে হবে।
কিন্তু যদি আমরা নিজেদের বদলাই, সত্যিকার মানুষ হই, তবে আগামী প্রজন্মকে আমরা শুধু স্বাধীন দেশ নয়, একটি ন্যায়ভিত্তিক, সুশিক্ষিত ও সমৃদ্ধ সমাজ উপহার দিতে পারবো।
প্রকাশক ও সম্পাদক : জিল্লুর রহমান
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত